মঙ্গলবার, মার্চ ২৩, ২০২১




দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সার্বিকভাবে ঝুঁকির আশঙ্কা

নারায়ণগঞ্জ প্রতিদিন:

বাংলাদেশ ব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে উন্নয়ন প্রকল্পে অব্যাহতভাবে ঋণ দেয়ার কারণে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সার্বিকভাবে ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন।এ ব্যাপারে তারা সরকারকেও সতর্ক করেছেন।এরপরও সম্প্রতি রিজার্ভ থেকে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষকে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ওরিয়ন গ্রুপও রিজার্ভ থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য আবেদন করেছে। বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ) রিজার্ভ থেকে বেসরকারি বিদ্যুৎ প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে।

এদিকে আইএমএফ বলেছে, রিজার্ভ থেকে ঋণ দিলে সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রিজার্ভ থেকে ঋণ দিতে গেলে জিডিপি ও রিজার্ভের যে অনুপাত থাকা প্রয়োজন, বাংলাদেশের তা নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বর্তমান রিজার্ভ ৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলার হলেও মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে উত্তরণকালে এটি পর্যাপ্ত কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। রিজার্ভ থেকে আমদানি ব্যয় ও অন্যান্য দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ঝুঁকির মাত্রাটি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, জরুরি প্রয়োজন বা ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য রিজার্ভ রাখা হয়। যেখানে-সেখানে এর ব্যবহার যুক্তিসংগত নয়।

১৫ মার্চ রিজার্ভ থেকে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ দিতে সরকার বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (বিআইডিএফ) গঠন করেছে। এ তহবিল থেকে বছরে ২০০ কোটি ডলার বা স্থনীয় মুদ্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বে এ ধরনের তহবিল গঠন বাংলাদেশেই প্রথম। প্রধানমন্ত্রী তহবিল গঠনের নীতিমালাটি অনুমোদন করেছেন। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। নীতিমালা নিয়ে বাংলাদশ ব্যাংক এখন কাজ করছে।

জরুরি প্রয়োজন বা ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য রিজার্ভ, যেখানে-সেখানে এর ব্যবহার যুক্তিসংগত নয়-এমন মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় এসব অর্থ বাজারে যাবে। এতে একদিকে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়বে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থকে বলা হয় ‘হাই পাওয়ার্ড মানি’ বা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অর্থ, যা বাজারে এসে দ্বিগুণের বেশি টাকার সৃষ্টি করবে। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে। ব্যাংকগুলো বড় প্রকল্পে অর্থায়নের সক্ষমতা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।

সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণের জন্য সিন্ডিকেশন বা কয়েকটি ব্যাংক মিলে ঋণ দেওয়াকে উৎসাহিত করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে এটি ব্যাপকভাবে হলেও এখন হচ্ছে খুব সীমিত আকারে। উন্নয়ন প্রকল্পে রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ না দিয়ে ব্যাংকগুলোর সিন্ডিকেশনের মাধ্যমেও বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দেওয়া যেত।

নীতিমালা অনুযায়ী এ তহবিল থেকে ঋণ পেতে হলে সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প হতে হবে। এর বিপরীতে সরকার গ্যারান্টি দিলে তবেই ঋণ পাওয়ার যোগ্য হবে। প্রকল্পকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে হবে। দেশি-বিদেশি যেসব উদ্যোক্তা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করবে, তাদেরও এ প্রকল্প থেকে ঋণ দেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) প্রেসিডেন্ট ইমরান করিম বলেন, আমরা অবশ্যই চাই রিজার্ভ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভালো ভালো প্রকল্পে অর্থায়ন করা হোক। তবে এই টাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যাতে শৃঙ্খলা বজায় থাকে, সেটা কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে টাকাটা উদ্যোক্তারা পাবেন, সেটি যাতে খুব বেশি শক্তিশালী হয়। এমন প্রক্রিয়া করতে হবে যাতে রিজার্ভ থেকে টাকা নিয়ে তা ফেরত দিতে বাধ্য হয়। ভালো উদ্যোক্তাদের বেছে বেছে ঋণ দিতে হবে। কারণ বড় বড় প্রকল্পে ও রিজার্ভ থেকে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নজরে রাখবে। এখানে কোনো সমস্যার সৃষ্টি করা যাবে না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এর মানে হচ্ছে-শুধু যে সরকারি খাতের উন্নয়ন প্রকল্পেই রিজার্ভ থেকে ঋণ দেওয়া হবে তা নয়, বেসরকারি ও বিদেশি উদ্যোক্তাদেরও ঋণ দেওয়া হবে। এতে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেশি বাড়বে। গ্যারান্টি থাকায় ঋণ পরিশোধে প্রকল্পটি ব্যর্থ হলে তা সরকারের প্রচ্ছন্ন দায়ে পরিণত হবে। একটি সময়ে তা সরাসরি দায়ে পরিণত হলে সরকার চাপে পড়বে। একই সঙ্গে বেড়ে যাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।

সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ দিয়ে বিআইডিএফসহ এখন পর্যন্ত পাঁচটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। সব তহবিলেরই একটি নির্দিষ্ট আকার আছে। কিন্তু বিআইডিএফের কোনো স্থায়ী আকার নেই। শুধু বলা হয়েছে, বছরে ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়া হবে।

এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে চারটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-২০ কোটি ডলার তহবিল, ২০ কোটি ইউরো তহবিল, ৫০০ কোটি ডলারের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) এবং ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন অ্যান্ড ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটির (আইপিএফএফ) ৪২ কোটি ডলারের একটি তহবিল। প্রথম চারটি তহবিলের সব বৈদেশিক মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জোগান দেওয়া হয়েছে।

শেষ তহবিলটির ৬ কোটি ডলার রিজার্ভ থেকে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাকি ৩৬ কোটি ডলার বিশ্বব্যাংক দিয়েছে। এসব তহবিলের সুদের হার দেড় থেকে ৪ শতাংশ। এর আগে রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ বিমানকে ৩০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।

রিজার্ভ থেকে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি হিসাবে দেখানো হয়, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণ নেওয়া হচ্ছে। এতে সুদের হার বেশি। দাতাদের নানা শর্ত মানতে হয়। অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে হয়। ফলে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। রিজার্ভ থেকে সুদে ঋণ নিলে এসব বাড়তি ঝামেলা হচ্ছে না। ব্যয়ও কম হবে। এ কারণে রিজার্ভ থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে বিদেশ থেকে ঋণ নিলে গড়ে সুদের হার ৬ শতাংশ। রিজার্ভ থেকে দেওয়া হচ্ছে দেড় থেকে ৪ শতাংশ সুদে।

আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ এখন যথেষ্ট। কিন্তু অতিরিক্ত নয়। রিজার্ভ থেকে ঋণ দিলে সেগুলো ফিরে না এলে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে। দেশে এমনিতেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি।

সূত্র জানায়, রিজার্ভ থেকে সরাসরি ঋণ দিতে হলে দেশের মোট জিডিপি ও রিজার্ভের অনুপাত অনেক উচ্চমাত্রায় থাকতে হবে। চলতি অর্থবছরে জিডিপির (মোট দেশীয় উৎপাদন) আকার ধরা হয়েছে ৩১ লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকা। রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় ৩ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা। জিডিপির তুলনায় রিজার্ভের অনুপাত হচ্ছে ৯ দশমিক ১। অর্থাৎ, মোট জিডিপির ৯ ভাগের এক ভাগের সমান হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এটি কমপক্ষে ৩ ভাগের উপরে যেতে হবে। যেটি অর্জন করা বেশ কঠিন।

Spread the love
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × 4 =

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর