বুধবার, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২০




লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা কী ?

পুস্তকের শ্রেণিবদ্ধ সংগ্রহকে লাইব্রেরী বা গ্রন্থাগার বলে।
ইংরেজি Library শব্দের বাংলা অর্থ হচ্ছে গ্রন্থাগার বা পাঠাগার।
গ্রন্থাগার শব্দের সন্ধিবিচ্ছেদ হচ্ছে গ্রন্থ + আগার = গ্রন্থাগার।
অর্থাৎ গ্রন্থাগার হচ্ছে গ্রন্থের আগার বা সংগ্রহশালা।
আরো সহজ করে যদি বলি মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এবং মানুষের পাঠের জন্য বিভিন্ন গ্রন্থ যে ঘরে রাখা হয় তাই গ্রন্থাগার বা পাঠাগার।
লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার সাধারণত তিন প্রকারের হয়ে থাকে।
যথা – ১. ব্যক্তিগত লাইব্রেরি
২. পারিবারিক লাইব্রেরি
৩. সর্বজনীন লাইব্রেরি।
যে লাইব্রেরির বইপুস্তক ব্যক্তি তার নিজস্ব প্রয়োজনে বা ব্যক্তিগতকাজে ব্যবহার করে তাকে ব্যক্তিগত লাইব্রেরি বলে।
আর যে লাইব্রেরি পারিবারিক কাজের জন্য ব্যবহার করা হয় তাকে পারিবারিক লাইব্রেরি বলে।
যে লাইব্রেরি সমাজের সব মানুষের পছন্দের কথা বিবেচনায় রেখে গ্রন্থ নির্বাচন করে তাকে সর্বজনীন লাইব্রেরি বলে।
সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করে। আবার যে ব্যক্তি বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করে তাঁর সবটুকু জ্ঞান তাঁর মস্তিষ্কে ধারণ করে রাখাও সম্ভব নয়। তাই প্রয়োজন এমন একটি উপায় উদ্ভাবনের যার মাধ্যমে দরকার অনুযায়ী সমস্ত বিষয়ের একটি মোটামুটি জ্ঞান লাভ করা যায়। তাই লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগারের সৃষ্টি হয়েছে।
গ্রন্থাগার শিক্ষার আলোকবর্তিকা হিসাবে কাজ করে। সমাজের সব শ্রেণি পেশার মানুষ গ্রন্থাগারে লেখা পড়ার সুযোগ পায়। তাই গ্রন্থাগারকে বলা হয় জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়।
মানুষের বই পড়ার আগ্রহ থেকেই গ্রন্থাগারের উৎপত্তি। গ্রন্থাগারের ইতিহাস বেশ পুরোনো। প্রথম দিকে মানুষ নিজের গৃহের কোণে, মসজিদ, মন্দির, গীর্জা কিংবা উপাসনালয়ে বা রাজকীয় ভবনে গ্রন্থ সংরক্ষণ করা শুরু করে। ইতালির রোমে প্রথম সর্বজনীন গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে পাঠ্য বইয়ের বাইরে যাওয়ার স্বাধীনতা শিক্ষার্থীদের নেই। এই পদ্ধতি তাকে স্বশিক্ষিত তো করেই না বরং স্বশিক্ষিত হওয়ার শক্তিটুকু পর্যন্ত নষ্ট করে দেয়। কিন্তুু গ্রন্থাগার সবার জন্য উন্মুক্ত এবং অবাধ। পাশাপাশি সব ধরণের গ্রন্থ থাকে এখানে।

দেহের পুষ্টি যোগায় খাদ্য আর মনের পুষ্টি যোগায় বই। শরীর অসুস্থ হলে আরোগ্য লাভের জন্য যেমন প্রয়োজন হাসপাতালের। তেমনি মনের অসুস্থতা দূর করার জন্য প্রয়োজন লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগারের।তাই বই হয়ে উঠেছে সভ্য সমাজের প্রতিটি মানুষের নিত্য সঙ্গী।
সমাজ হলো কিছু মানুষের মনের অবস্থা বা গুনবিশেষ।

এখানে মনকে যে শাসন করবে বা সঠিক পথে পরিচালনা করবে সে হলো আমাদের জ্ঞান। আমরা সবাই জানি জ্ঞান থাকে বইয়ে। আর সেই বইগুলি কিন্তুু থাকে গ্রন্থাগারে।
জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গঠন করা খুব সহজ কাজ নয়।কিন্তুু একবার যদি তা করা যায়। তবে সে সমাজের মতো সমৃদ্ধ, উন্নত এবং সুখী সমাজ আর একটাও পাওয়া যাবে না।
বই মানুষকে কখনো বিমুখ করে না। যে ব্যক্তি যা চায় বই কিন্তুু তাকে তাই দেয়। তাই ভালো কিছু গ্রহণ এবং মন্দ বা খারাপ বিষয় বর্জন করার মতো বুদ্ধিটাও আসে বই পাঠের মধ্য দিয়ে। বলা হয়ে থাকে যে, একটি দেশকে যদি তুমি ধ্বংস করতে চাও তাহলে সে দেশের লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগারগুলিকে ধ্বংস করে দাও। আর এই কথাটি যে কতটুকু সত্য তা অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে তাকালেই ভালোভাবে বুঝা যায়।
গ্রন্থাগার হচ্ছে একটি জাতির অগ্রগতির প্রতীক। সমাজ,সভ্যতা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির বাহন।অতীতের সাথে বর্তমানের, বর্তমানের সাথে ভবিষ্যতের যোগসূত্র স্থাপন করে গ্রন্থাগার।

অনেকের মতে জ্ঞান অর্জনের দুটি উপায় রয়েছে। একটি হলো ভ্রমণ করে আর অপরটি হলো বই পড়ে।ভ্রমণ করে জ্ঞান অর্জন করতে হলে বিত্তশালী হতে হয়। কারণ ভ্রমন করতে প্রচুর টাকা পয়সার প্রয়োজন হয়। তাই আমরা জ্ঞান অর্জনের সহজ মাধ্যম হিসাবে বইকে বেছে নিতে পারি।

আমাদের এই সমাজে যে হারে সন্ত্রাস, অন্যায়, অবিচার এবং মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে তার মূলে রয়েছে গ্রন্থাগার বিমুখতা। বর্তমানে আমাদের যুব সমাজ যে ভাবে অপসংস্কৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো যুবসমাজ কে গ্রন্থাগার মুখী করে তোলা।
একটি জাতির চিন্তা-চেতনা কেমন হয় তা নির্ভর করে সেই জাতির জ্ঞান চর্চার উপর। যে কোন জাতির নীতি – নৈতিকতা, সহনশীলতা, আদর্শ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে প্রতিষ্ঠা করতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সুস্থ জীবনবোধ। আর এটি অর্জন একমাত্র সম্ভব বই পাঠের মাধ্যমে। তাই সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, গ্রন্থগারের প্রয়োজনীয়তা স্কুল কলেজের চেয়ে বেশি। কারণ এটি একটি গতিশীল প্রতিষ্ঠান এবং গ্রন্থাগার মানুষের মধ্যে সামাজিকতা, নৈতিকতা, অধিকার ও কর্তব্যবোধ, পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু মানসিকতা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বই পড়ে আমরা যদি জ্ঞানের অভাব দূর করতে পারি তাহলে সম্পদের অভাব ও আমাদের বেশি দিন থাকবে না। সে জন্য আমাদেরকে নিয়মিত পাঠক হতে হবে। বিজ্ঞান মনস্ক জাতি হতে হবে। গ্রন্থাগারে গিয়ে গ্রন্থ পাঠের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
কবি ও লেখক জসীমউদ্দীনের মতে, বই আপনাকে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সকল কালে নিয়ে যেতে পারে। যে দেশে কোনদিন কিংবা কখনো যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বইয়ের রথে চেপে অনায়াসে আপনি সেই দেশে যেতে পারেন।
এই জগতে সব ধরনের নেশার অপকার রয়েছে কিন্তুু বইয়ের নেশায় কোন অপকার নেই। কেননা বই নিজেই একটি উন্নত মূল্যবোধেরে অনন্য এক প্রতিষ্ঠান।গ্রন্থাগার সমাজ উন্নয়নের বাহন এবং শিক্ষা সমাজ উন্নয়নের মূল ভিত্তি। শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষ উন্নয়ন মনস্ক হয়। গ্রন্থাগার শিক্ষার আলোকবর্তিকা আর আমাদের চিত্ত, জ্ঞান ও চিন্তা শক্তি বিকাশের চিরন্তন বাতিঘর হিসাবে কাজ করে।

টুপারের মতে, বই হলো আমাদের বর্তমান ও চিরদিনের পরমবন্ধু।আর এই বইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে যেতে হবে গ্রন্থগারে। কারণ বইয়ের নির্ভরশীল আশ্রয়স্থল হচ্ছে গ্রন্থাগার।তাই এক কথায় গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
আমরা আমাদের অবসরের সময়টুকু অযথা আজেবাজে কাজে নষ্ট না করে উপযুক্ত কাজে ব্যয় করলে জীবন আরো সমৃদ্ধ ও সুন্দর হয়ে উঠতে পারে।

আমাদের হয়তো অনেকেরই জানা নেই যে, আমাদের জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস কোনটি? বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালে ৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। ২০১৮ সাল থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।
প্রতিনিয়ত হাতে মোবাইল অথবা ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদেরকে সমাজ বিচ্ছিন্ন, বিবেকহীন, নৈতিকতা, মানবিকতা ও মূল্যবোধহীন যান্ত্রিক প্রাণিতে পরিণত করছে। এর ফলে বর্তমানে সমাজে নানাবিধ অপরাধ ও অপকর্ম দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশের তরুনরা মাদক ও ভার্চুয়াল অপরাধে আকৃষ্ট হয়ে জীবনকে প্রতিনিয়ত ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক ও পক্ষপাতমুক্ত সমাজ গড়ার সহায়ক শক্তি হচ্ছে লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সমালোচক, গবেষক, প্রকাশক ও গ্রন্থগারিক। তাই গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারকে বলা হয় মানব সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপাদান।

উপযুক্ত কাজের অভাবে আমরা প্রয়োজনীয় ও করণীয় কাজ ভুলে প্রতিনিয়ত আত্মিক সৌন্দর্য হারিয়ে নিষ্প্রভ ও শ্রীহীন হয়ে যাচ্ছি। আমরা চাইলেই সময়ের সুব্যবহার করে আমাদের এই জীবনকে আরো অর্থবহ এবং মহান করে তুলতে পারি। আমরা চাইলেই জ্ঞানের আলোয় অবগাহন করে ব্যক্তিত্বকে দৃঢ় ও শানিত করে এই জীবনকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে পারি। আমাদের প্রিয় এই মাতৃভূমিকে উন্নয়নের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিতে পারি।
সুতরাং জ্ঞান অর্জনের কোন বিকল্প নেই। সুখী, সমৃদ্ধ এবং উন্নত বাংলাদেশের গড়ার জন্য আসুন প্রতিদিন গ্রন্থাগারে যাই।আসুন বই পড়ি, জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গড়ি।

মাহফুজুল ইসলাম হায়দার (সেলিম)
সহকারী অধ্যাপক,
ইতিহাস বিভাগ, পরশুরাম সরকারি কলেজ, ফেনী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

15 − 6 =

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর